সফিকুল ইসলাম
স্থানীয়ভাবে নিজস্ব বলয় তৈরি করে কিংবা দলের প্রভাবশালীদের ‘বিশেষ আশীর্বাদ’ নিয়ে অতীতে অনেক অজনপ্রিয় নেতাও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ভাগিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয় ওইসব নেতারা ‘বিশেষ আশীর্বাদ’ কাজে লাগিয়ে অনেকে জয়লাভও করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এতে দলের সেইসব ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ নেতারা বিশেষ টেনশনে পড়েছেন। তবে বিপরীতে ‘স্থানীয় বলয়’ ভেদ করে কেন্দ্রের সুদৃষ্টি কাড়তে না পারা তৃণমূলের ক্লীন ইমেজ ও জনপ্রিয় নেতাদের মধ্যে বইছে আনন্দধারা। তবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা না থাকার পরও স্থানীয় কোন্দলের কারণে অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হতেন। এই তিন পক্ষের ‘কাড়াকাড়িতে’ অনেক সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। এবার এসব পরিস্থিতি এড়িয়ে আওয়ামী লীগ চাচ্ছে, প্রকৃত জনপ্রিয় নেতারাই স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি হিসেবে জয়লাভ করুক।
উপজেলায় প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ থাকছে আ’লীগের : এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দেয়া থেকেই শুধু বিরত নয়, প্রার্থী হওয়া ও প্রার্থীর কর্মী সমর্থক হওয়ার ক্ষেত্রেও দলের কোনো নিয়ন্ত্রণও রাখছে টানা চতুর্থ মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দল আওয়ামী লীগ। ফলে নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য দলীয় তৎপরতা ও ব্যস্ততাও নেই দলটির। দেশের মোট ৪৯৫টি উপজেলায় চার ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট আগামী ৮ মে। স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দলীয় কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের যেকোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামতে দেখা যায়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আগামীতে স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে দলের প্রতীক ব্যবহার না করা ও দলীয়ভাবে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। শুধু তাই নয় পরোক্ষভাবেও কোনো প্রার্থীকে দলীয় সমর্থন দেয়া হবে না বলেও দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইন হওয়ার আগে এসব নির্বাচন যখন নির্দলীয় ছিল, তখনও প্রত্যেক জায়গায়ই অঘোষিতভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকতো। বিভিন্নভাবে যাচাইবাছাই করে প্রার্থী ঠিক করা হতো ও দলের নেতাকর্মীদেরকে দল সমর্থিত ওই প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশ থাকতো। কিন্তু এ নির্বাচনে পরোক্ষভাবেও কোনো প্রার্থীকে সমর্থন বা কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা না করার ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগের দলীয় কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। যে যাকে ইচ্ছা সমর্থন দিতে পারবে এবং তার পক্ষে কাজ করতে পারবে। এ কারণেই নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে দলের মধ্যে আগের মতো প্রস্তুতিমূলক কোনো তৎপরতাও নেই।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মূলত বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত, স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও উৎসবমুখর করে তোলা এবং বিগত সংসদ নির্বাচন ও অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সহিংসতা বিশ্লেষণ করে আওয়ামী লীগ এবার দলীয় প্রতীক প্রদান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে, স্থানীয়ভাবে দলীয় বিভেদ এবং জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী কোন্দল আরও বাড়তে পারার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া নিজ দলের কোন্দলের সুযোগ নিতে পারে বিএনপি বা অন্য কোনো দলের প্রার্থীরা। এমন বাস্তবতা সামনে রেখেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী ৮ মে ১৫২টি উপজেলায় প্রথম ধাপে নির্বাচন হবে। তবে পূর্ণাঙ্গ তফসিল ঘোষণার আগেই ভোটের তারিখ জানিয়ে দেয়ায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে কাজ শুরু করেন। উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন বা প্রতীক বরাদ্দ না দেয়ার সিদ্ধান্তকে অনেকে দলটির জন্য চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করছেন। তবে এটাকে নির্বাচনে প্রতিযোগিতার নামে সংঘাতে জড়ানো বা কোনো অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণে দেরি হবে না বলেও হুশিয়ারি রয়েছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে তৃণমূল নেতা ও নবনির্বাচিত দলীয় এমপি এবং দল অনুমোদিত স্বতন্ত্র এমপিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন। কেউ দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ভুল করবেন না বলেও হুশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। গত বুধবার কয়েকজন কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সিটি করপোরেশনের মেয়র, এমপি, তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে গণভবনে কথা বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানেও ঐক্যবদ্ধ থাকার বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে কথা বলেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল রাজনীতির মাঠ সরগরম করে রাখছেন প্রার্থীরা। শোডাউন, বৈঠক, কর্মিসভা, পথসভা, মিছিল-মিটিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন তারা। এবার স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও এমপির চেয়ে জনগণের সুদৃষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ উদীয়মান প্রার্থীদের। অন্যদিকে পুনরায় যারা প্রার্থী হচ্ছেন তারা স্থানীয় বলয় তৈরি করেই ফের নির্বাচিত হতে চান। ফলে নতুন-পুরাতনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হচ্ছে কোথাও কোথাও। সামনে আরও বেশি হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। এ বিষয়টিকে আমলে নিয়েই যেসব এলাকার চিত্র নেতিবাচক, সেসব এলাকার নেতাদের পর্যায়ক্রমে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হচ্ছে। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা কথা বলবেন এবং দলীয় হাইকমান্ডের বার্তা পৌঁছে দেবেন। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার ভাষ্য, উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে দেশের বেশকিছু এলাকায় দ্বিধাবিভক্তি লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপি নির্বাচনে না আসার কথা বললেও সারাদেশের বেশকিছু স্থানে তাদের দলের প্রার্থীদের শোডাউন দেখা যাচ্ছে। ফলে দলে এই দ্বিধাবিভক্তি না কাটাতে পারলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে। এই বোধ থেকেই তৃণমূলকে পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রে ডাকা হচ্ছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, এবারের উপজেলা নির্বাচনে আমাদের দলের যে কেউ অংশগ্রহণ করতে চাইলে করতে পারবে। দলীয় প্রার্থী থাকবে না এটাতো আগেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করার আইন হওয়ার আগে আমরা দল থেকে প্রার্থী সমর্থন দিয়েছি, কিন্তু এবার সেটাও দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, এখন পর্যন্ত দলে যে সিদ্ধান্ত আছে, এতে মনে হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কার কতটা জনপ্রিয়তা তা যাছাই-বাছাইয়ের উৎকৃষ্ট সুযোগ। সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থীই জনপ্রতিনিধি হয়ে আসবে। নির্বাচন উৎসবমুখর হবে, অংশগ্রহণমূলক হবে। এই কারণ থেকেই এটা করা (প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের সিদ্ধান্ত) হয়েছে। এতে দলে বিভাজন বা দ্বন্দ্ব-সেটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আংশিক হলে হতে পারে। তবে তা নিরসনের জন্য নেতৃবৃন্দ ব্যবস্থা নেবেন অবশ্যই। একই সুরে কথা বলেছেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি। তিনি বলেন, আমরা তো দলীয় প্রতীক দিয়ে কোনো নির্বাচন করছি না। সুতরাং ওই অর্থে কোনো চ্যালেঞ্জ আমি দেখি না। আমরা শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। যে নির্বাচনে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেবে। জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করুক সেটা আমরা চাই। তিনি আরও বলেন, দলের বিরুদ্ধে দল, নৌকার বিরুদ্ধে নৌকা যেন না হয় সে কারণেই দলীয় প্রতীক ব্যবহার করছি না। তাতে এলাকাভিত্তিক জনপ্রিয়তায় প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। সম্প্রতি কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন হয়েছে। সেখানে কোনো সংঘাত হয়নি, রক্ত ঝরেনি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
